Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

এখনও নেতাজীকে কেন এত ভয় ? - 1



ভূমিকা

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা শুধু অমর নয়, বরং আজও অনেক স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে অস্বস্তিকর। কারণ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন এমন এক বিপ্লবী চিন্তার প্রতীক, যিনি স্বাধীনতার লড়াইকে কেবল রাজনৈতিক দরকষাকষির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁর দৃষ্টিতে স্বাধীনতা মানে ছিল সম্পূর্ণ মুক্তি — রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক। আর সেই মুক্তির জন্য তিনি তৈরি করেছিলেন এক সেনাবাহিনী, যাকে আজও ভারতীয় জনগণ শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করে: আজাদ হিন্দ ফৌজ।

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, ভারত স্বাধীন হবার পর থেকে আজ অবধি প্রতিটি শাসকগোষ্ঠী নেতাজীর প্রসঙ্গেই আতঙ্কিত। নেহরু থেকে মোদি—কেউই নেতাজীর সত্যকে পুরোপুরি সামনে আনতে সাহস করেননি। কেন?

কারণ, নেতাজীর জীবনের সত্য মানেই ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখা। মানে স্বাধীনতার কৃতিত্ব আর কেবলমাত্র কংগ্রেস বা গান্ধী-নেহরুর একচেটিয়া কাহিনী নয়। মানে ব্রিটিশরা সত্যিই ভয় পেয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজকে, আর ভারতীয় সেনারা স্বাধীনতার জন্য ভিতরে ভিতরে জেগে উঠেছিল। মানে “অহিংসা” একমাত্র পথ নয়, বরং “সশস্ত্র বিপ্লব”ও ছিল ইতিহাসের আসল চালিকাশক্তি।

আজও নেতাজীর নামে মানুষ জেগে ওঠে, আজও তাঁর ছবি মিছিলের শিরোনাম হয়, আজও তাঁর চিন্তা ক্ষমতাসীনদের চেয়ারে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। নেতাজী মানে শুধুই অতীত নয়—নেতাজী মানে এক চিরন্তন বিপ্লবী শক্তি, যা প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে পারে।

তাই তাঁকে নিয়ে ভয় আজও এত প্রবল। কারণ যদি সত্যিটা প্রকাশ পেয়ে যায়, তবে স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের রাজনৈতিক ভিত্তি কেঁপে উঠবে। নেতাজীর উত্তরাধিকার মানেই অন্য এক ভারত।
—এক সাহসী, সামরিকভাবে প্রস্তুত, আত্মনির্ভর ও একত্রিত এক অখণ্ড ভারত। আর সেই ভারতকে সামনে আসতে দিতে চায়নি, আর আজও দিতে চায় না, শাসকেরা। তাই আমাদের এই ধারাবাহিক লেখার মূল অগ্নিশিখা হচ্ছে—
“এখনও নেতাজীকে কেন এত ভয় ?”

এই রচনায় আমরা আর “বিমান দুর্ঘটনা” বা “গুজব”-এর চর্বিতচর্বন করব না। আমরা খুঁজব একটাই উত্তর:

কেন এত ভয়?

কেন সত্য গোপন রাখা হলো?

কেন নেতাজীর ছায়া আজও রাজনীতির জন্য বিপজ্জনক?


পাঠক, যদি সত্যিই জানতে চান ভারতের সবচেয়ে বড় অজানা ইতিহাস, তবে এই লেখার প্রতিটি অধ্যায় আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে এক অগ্নিগর্ভ যাত্রায়—যেখানে নেতাজী শুধু ইতিহাস নন, তিনি আজও আমাদের ভবিষ্যৎ।




পর্ব ১ : নেহরু যুগে ভয়ের শিকড়:

ভারত স্বাধীন হলো ১৯৪৭ সালে। কিন্তু স্বাধীনতার ভোরের ঠিক আগেই এক ছায়া দেশের আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল—নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ছায়া। কংগ্রেসের নেতারা তখন দেশের ক্ষমতা দখল করতে ব্যস্ত, গান্ধীজি ছিলেন নৈতিক কর্তৃত্বের শীর্ষে, আর জওহরলাল নেহরু হতে যাচ্ছেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ঠিক এই সময়েই প্রশ্নটা ছিল সবচেয়ে বড়—“নেতাজী কোথায়?”

যদি তিনি সত্যিই জীবিত থেকে ফিরে আসতেন, তবে নেহরুর নেতৃত্ব মুহূর্তেই নড়বড়ে হয়ে যেত। কারণ নেতাজীর জনপ্রিয়তা ছিল সর্বব্যাপী। গ্রাম থেকে শহর, শ্রমিক থেকে সেনা—সবাই তাঁকে নিজের নেতা মানত। তিনি কেবল কংগ্রেসের এক প্রাক্তন সভাপতি নন, তিনি ছিলেন এক বিকল্প ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা। সেই স্বপ্ন ছিল অনেক বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি বাস্তববাদী, আর সবচেয়ে বড় কথা—কংগ্রেসের একচেটিয়া ক্ষমতার বাইরে।

নেহরু খুব ভালোভাবেই জানতেন, নেতাজীর ছায়া থাকলেই তাঁর নিজের অবস্থান অনিশ্চিত। তাই স্বাধীনতার পরপরই শুরু হয়েছিল নেতাজী-সম্পর্কিত তথ্য গোপন রাখার এক বিশাল পরিকল্পনা। সরকারি স্তরে গোয়েন্দা সংস্থাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল নেতাজীর পরিবারকে নজরদারিতে রাখতে। কলকাতার বোস পরিবার প্রায় দুই দশক ধরে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর কড়া পর্যবেক্ষণে ছিল। তাদের চিঠিপত্র খোলা হতো, ফোনে আড়ি পাতা হতো। এক স্বাধীন দেশে এমন নজরদারি—এটাই প্রমাণ করে, নেতাজীর নাম নেহরু সরকারের কাছে ছিল এক ভয়ের প্রতীক।

আরেকটা বড় কারণ ছিল ইতিহাসের নিয়ন্ত্রণ। স্বাধীনতার কৃতিত্ব যদি সঠিকভাবে ভাগাভাগি করতে হতো, তবে গান্ধী-নেহরু অধ্যায়ের পাশে আজাদ হিন্দ ফৌজের অধ্যায়ও সমানভাবে স্থান পেত। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব সেটা হতে দেয়নি। পাঠ্যপুস্তকে আইএনএ-র অবদানকে ছোট করে দেখানো হলো। এভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নেতাজীকে প্রধান চরিত্র নয়, বরং পার্শ্বচরিত্রে পরিণত করার চেষ্টা চলল।

নেহরু সরকারের ভয়টা আসলে ছিল দ্বিমুখী। একদিকে নেতাজী ফিরলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব টিকবে না, অন্যদিকে জনগণ বুঝে যাবে—ভারতের স্বাধীনতা কেবল অহিংস আন্দোলনের ফল নয়। বরং আজাদ হিন্দ ফৌজের বিদ্রোহ, সেনাদের মানসিক পরিবর্তন, এবং ব্রিটিশদের মধ্যে সৃষ্ট আতঙ্কই ছিল আসল চালিকাশক্তি। যদি এই সত্য প্রকাশ পায়, তবে গান্ধী-নেহরুর কৃতিত্ব কমে যাবে—এটাই ছিল শাসকেরা সবচেয়ে বেশি ভয় পেত।

ফলাফল—স্বাধীনতার প্রথম দিন থেকেই নেতাজীর প্রসঙ্গ হয়ে উঠল এক নিষিদ্ধ ছায়া। সরকারি ভাষ্যে তাঁর মৃত্যু তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনায় ঘটেছে বলে প্রচার করা হলো। অথচ তাইওয়ান সরকারের নথি বলছে—সেই দিনে কোনো বিমান দুর্ঘটনাই ঘটেনি! তবুও সরকার সেই মিথ্যা কাহিনী আঁকড়ে ধরল, কারণ সত্য মানে রাজনৈতিক কাঁপুনি।

নেহরু যুগের এই ভয়ই পরবর্তী সমস্ত সরকারের কাছে নজির তৈরি করল। কেউ নেতাজীর সত্য সামনে আনতে সাহস করল না। কারণ নেতাজীর নাম মানেই নতুন প্রশ্ন, নতুন ইতিহাস, আর নতুন ভারতের দাবি।